উত্তরকাশি (Uttarkashi) মানে উত্তরের কাশি যা ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যে অবস্থিত। গঙ্গা নদীর তীরে যার অবস্থান। এটি উত্তরকাশি রাজ্যের জেলা সদর দপ্তর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১১৫৮ মিটার এবং এটি একটি পবিত্র শহর। উত্তরকাশিতে অনেক আশ্রম ও মন্দির আছে। কাশি (বেনারসের) নামে এই জায়গাটির নামকরণ প্রভাবিত হয়েছে যা বর্তমানে উত্তরাখন্ডের অন্যতম জনপ্রিয় প্রধান শহর। এটি রাজ্যের একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। সারাবছর ধরে এখানে প্রচুর পর্যটক ও পূর্ণার্থীরা আসেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা হিমালয় রেঞ্জের এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
পর্যটকরা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করে। এটি জানকি চাট্টি থেকে ১২২ কিমি দূরে, উখিমঠ থেকে ১৯৬ কিমি দূরে, বারকোট থেকে ৮২ কিমি দূরে, মসৌরি থেকে ১১৮ কিমি দূরে, গঙ্গোত্রী থেকে ১০১ কিমি দূরে, হরিদ্বার থেকে ১৯১ কিমি দূরে, রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ১৭৩ কিমি দূরে অবস্থিত। উত্তরকাশি আশেপাশের কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ও সংলগ্ন গঙ্গা নদীর অববাহিকার সৌন্দর্য্যর জন্য বিখ্যাত। উত্তরকাশিতে অনেক আকর্ষণীয় ঘোরার জায়গা রয়েছে। প্রচুর পর্যটক এইসব জায়গা ঘুরতে এখানে আসেন। হর কি দুন, গোমুখ, তপোবন, দধিতাল লেক, দয়ারা বুগিয়াল সহ বিভিন্ন জায়গায় ট্রেক করতে হলে এখান থেকে পারমিশন (পোরচি) নিতে হবে। পারমিশন এর জন্য সামান্য টাকা দিতে হয়। এই ডিএফও পারমিট (DFO Permit) অফিস ছয় দিন খোলা থাকে। রবিবার বন্ধ। এটি খোলা থাকে সকাল ১০.০০ থেকে বিকেল ৫.০০ টা পর্যন্ত।
গরমে এখানে অতি সুন্দর ও মনোরম আবহাওয়া বর্তমান। গরমের সময় উপরের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রীর আশেপাশে থাকে। আর নীচেরটা ১৩ ডিগ্রী। শীতে গড় তাপমাত্রা ০-১২ ডিগ্রী পর্যন্ত হয়। শীতে মারাত্বক ঠান্ডা পড়ে। এখানে সারা বছরই ঘোরা যায়। তবে গরম ও শীতে ঘোরার মজাটাই আলাদা।
দোদিতাল লেকটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এক আকর্ষণীয় জায়গা যা ট্রেকিংয়ের জন্য বিখ্যাত। লেকের জল খুবই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। এটি উত্তরকাশির অবশ্য ভ্রমণ করা জায়গা গুলির একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩০২৪ মিটার। উত্তরকাশি ভ্রমণ কালে প্রথমেই আপনি এই জায়গাটি চয়েজ করতে পরেন। উত্তরকাশি থেকে দোধিতাল লেকের দুরত্ব ২২ কিলোমিটার। দোধিতাল যেতে হলে প্রথমে আপনাকে সঙ্গমছাট্টি যেতে হবে। তরপর ১৯ কিমি ট্রেক করে দোধিতাল লেক পৌছাবেন। ভগবান গণেশের জম্মস্থান হিসেবে সঙ্গমছাট্টিকে ধরা হয়। আপনার রাত কাটানোর জন্য বানরা বা আগোরা নামে গ্রাম রয়েছে। এখানে ট্রেকিং করতে হলে বন দপ্তরের অফিস থেকে পারমিট জোগার করতে হবে। আপনাকে প্রচুর পরিমান শুকনো খাওয়ার ও জল বহন করতে হবে। কারণ সেখানে এসব জোগার করার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। ট্রেকিং করে দোধিতাল যাওয়া ও থাকার জন্য মোট ৪ দিন সময় লাগবে।
উত্তরকাশির একটি আকর্ষণীয় ও অবশ্য ভ্রমন করা পর্যটণ কেন্দ্রটির নাম নচিকেতা লেক। নচিকেতা লেকে পর্যটকেরা খুঁজে পাবেন আকর্ষণীয় চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশ। এটি উত্তরকাশির প্রধান শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। চৌরিঙ্গি খাল থেকে নচিকেতা লেকের ট্রেকিং পথে দুরত্ব ৩-৪ কিলোমিটার। লেকের জল স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। রং বেরঙের মাছ খেলা করছে। বৈদিক যুগে মুনি নচিকেতার নামে এই লেকের নামকরণ করা হয়েছে। নচিকেতা লেকের পাশে নাগ দেবতার মন্দির রয়েছে। আপনি ওখানে গেলে প্রচুর পরিমানে শুকনো খাওয়ার ও জল বহন করুন। কারণ ওখানে খাওয়ার ও পাণীয় জলের ব্যবস্থা নেই।
দায়ারা বুগিয়াল (Dayara Bugyal), প্রাকৃতি সৌন্দর্য্যে ভরা এটি একটি সুন্দর জায়গা, যা ট্রেকিং করার জন্য আদর্শ। প্রথমে দয়ারা বুগিয়ালে যাওয়ার জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। এরপর আপনি সেখানে যেতে পারেন। উত্তরকাশি থেকে লোকাল ট্যাক্সি(জন প্রতি ৮০ টাকা) ভাড়া করে আপনি পৌছিয়ে যাবেন ভাটয়ারী। এরপর বাতয়ারি থেকে যেতে হবে সোজা রাস্তায়। গাইডের সেভাবে দরকার নেই। রাস্তা চড়াইএর দিকে গিয়েছে। চড়াইয়ের রাস্তা শেষ হলেই পড়বে দায়ারা টপ। আপনি ওখানে গেলে প্রচুর পরিমানে শুকনো খাওয়ার ও জল বহন করুন। কারণ ওখানে খাওয়ার ও পাণীয় জলের ব্যবস্থা নেই। এরপর আপনি এখান থেকে অন্য রাস্তা ধরে যেতে পারেন সর্ব্বোচ্চ চূড়া বাকারিয়া টপ। এছাড়াও বুগিয়ালের অন্য রাস্তা থেকে যাওয়া যেতে পারেন বন্দর পুঞ্চ।
দয়ারা বুগিয়ালে ট্রেকিং করার হলে যেখান থেকে শুরু হয় তা হল বারসু গ্রাম। এখান থেকেই সাধারণত দয়ারা বুগিয়ালের ট্রেকিং শুরু হয়। এটি উত্তরকাশির রাস্তার ধারে অবস্থিত একটি ছোটো গ্রাম। বারসু গ্রামে আপনি প্রকৃতির সুন্দর ও চোখজুড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশের আস্বাদন করতে পারবেন। এখানে আপনি বিভিন্ন রং বেরঙের প্রজাপতি ও পাখি দেখতে পাবেন। এখানে জিএনভিএনের একটি গেস্ট হাউজ আছে। এছাড়া এখানে হোটেল ও হোম স্টে রয়েছে।
এটি উত্তরকাশি শহরে অবস্থিত একটি ছোটো মন্দির। বাসস্ট্যান্ড থেকে আনুমানিক ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এটি গঙ্গার পাশে অবস্থিত। এখানে যে ভগবানের মূর্তি রয়েছে, তা শক্তিদেবী হিসেবে শক্তি ও এণার্জীর প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়। মন্দির চত্বরটি সর্বদাই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ থাকে। মন্দিরটি বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রেমিসেসের ভেতরে অবস্থিত। মন্দিরের ভেতর একটি ত্রিশুল রয়েছে। যা শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়।
খোলার সময়: সকাল ৬.০০ থেকে রাত ৯.০০
উত্তরকাশির অন্যতম আবশ্যিক ভ্রমন করা পর্যটণ কেন্দ্রটির নাম বিশ্বনাথ মন্দির। এই মন্দিরটি ভগবান শিবের উদ্দ্যেশ্যে উৎসর্গীকৃত হয়েছে। এটি উত্তরকাশি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। উত্তরকাশি বাসস্ট্যান্ড থেকে এর দুরত্ব ৫০০ মিটার। বিশ্বনাথ মন্দিরটি গঙ্গার পাড়ে অবস্থিত। এটি ভারতের অন্যতম আদি মন্দির। যা শক্তি মন্দিরের বিপরীতে অবস্থিত। এখানে সারা বছর প্রচুর পর্যটক আসেন। বিশেষ করে চারধাম যাত্রার সময় এখানে প্রচুর পূণার্থীরা আসেন। উত্তরকাশির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হল বিশ্বনাথ মন্দির।
খোলার সময়: সকাল ৬.০০ থেকে রাত ৯.০০
ভারতের একটি অন্যতম বিখ্যাত ইন্সটিটিউট হল নেহেরু মাউন্টেনিং ইন্সটিটিউট। উত্তরকাশিতে এটি তৈরী হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ১৪ই নভেম্বর। এই ইন্সটিটিউটের নামকরণ করা হয়েছিল ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরুর নাম অনুসারে। এই ইন্সটিটিউটের চারিপাশে ঘন জঙ্গল ও পাহাড় দ্বারা আবৃত প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ। উত্তরকাশি প্রধান শহর থেকে এর দুরত্ব ২ কিলোমিটার।
খোলা থাকে: সকাল ৯.০০ থেকে বিকেল ৫.০০ পর্যন্ত।
গঙ্গার তীরে অবস্থিত কুতেতি দেবী মন্দির। হরি পর্বতের চূড়ার দিকে এটি অবস্থিত। উত্তরকাশি প্রধান শহর থেকে এর দুরত্ব ২ কিলোমিটার। এটি তৈরী করেছিলেন মহারাজা কোটার মেয়ে ও জামাই। দেবী কুতেতি তাঁদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন প্রতষ্ঠা করার জন্য। দেবী কুতেতি ভগবান দূর্গার আরেক রূপ। দেবী কুতেতির দেখান স্বপ্ন অনুসারে এই মন্দির তৈরী করা হয়েছিল। পর্যটকরা এখানে গিয়ে মন্দির দেখার পাশাপাশি পাহাড়ের উপর থেকে কাছাকাছি লেক,সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ল্যান্ডস্কেপ এবং ঝর্ণা উপভোগ করেন।
উত্তরকাশির একটি আকর্ষণীয় পর্যটণ কেন্দ্রটির নাম মনেরি বাঁধ। এটি উত্তরকাশি থেকে ১২ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত। এটি গঙ্গোত্রি যাওয়ার পথে পড়ে। ভাগীরথি নদীর উপর কংক্রিটের বাঁধ হল এই মনেরী বাঁধ। বর্তমানে এটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে। মনেরী বাঁধ থেকে আপনি সুন্দর চোখ জুড়ানে দৃশ্য্ উপভোগ করতে পারবেন।
কলকাতা থেকে ট্রেনে
উত্তরকাশি যাওয়ার কোনো সরাসরি ট্রেন নেই। এর কাছাকাছি রেলওয়ে স্টেশন হলো দেরাদুন বা হরিদ্বার। কলিকাতা থেকে হরিদ্বার বা দেহরাদুন যাওয়ার কিছু ট্রেন রয়েছে। আপনি হরিদ্বার বা দেহরাদুন থেকে গাড়ী ভাড়া করে যেতে পারবেন। এছাড়াও ঋষিকেশ বা দেহরাদুন থেকে উত্তরকাশি যাওয়ার বাস পেয়ে যাবেন।
দিল্লী থেকে ট্রেন
মুম্বাই থেকে ট্রেন
বান্দ্রা টার্মিনারর্স হরিদ্বার এসএফ এক্সপ্রেস ২২৯০৭(সুপার ফাস্ট) .. বান্দ্রা টার্মিনারর্স..দুপুর ১.০৫- হরিদ্বার বিকেল ৩.৫০, সপ্তাহে ১ দিন, সময়-২৬.৪৫ ঘন্টা।
উত্তরকাশিতে থাকার জন্য অনেক হোটেল রয়েছে। ঘরের ভাড়া ৩০০ রুপী থেকে শুরু হয়ে ২০০০ রুপী পর্যন্ত রয়েছে। সিজনে অবশ্য হোটেলের রেটটা একটু বেশী থাকে। সিজন ছাড়া আগে থেকে বুক না করলেও অসুবিধা নেই। রুম পেয়ে যাবেন।
কচুরি, ডাল, রুটি, ভাত, বিভিন্ন ধরনের সব্জি, মিস্টি এখানে সহজেই পাওয়া যায়। খাবারের দামও নাগালের মধ্যে।
Leave a Comment