লালমনিরহাট

তুষভান্ডার জমিদার বাড়ি

লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ি (Tushbhandar Jamidar Bari), একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা যা প্রায় চারশত বছরের গৌরবময় ইতিহাস বহন করে। এই জমিদার বাড়ির নামকরণের পেছনে রয়েছে এক অদ্ভুত কাহিনী, যা ধানের তুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

প্রতিষ্ঠা ও নামকরণ

প্রায় চারশত বছর পূর্বে, মহারাজা প্রাণ নারায়ণের শাসনামলে (আনুমানিক ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ), চব্বিশ পরগনা থেকে মুরারিদেব ঘোষাল ভট্টাচার্য কোচবিহারে আসেন “রসিক রায় বিগ্রহ” নামক একটি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে। রাজা প্রাণ নারায়ণ, ঘোষাল ভট্টাচার্যকে বিগ্রহ পূজার জন্য নয়টি মৌজা দান করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ হওয়ায় ঘোষাল ভট্টাচার্য এই দান গ্রহণে আপত্তি জানান এবং রাজাকে সম্পত্তি ভোগের বিনিময়ে খাজনা প্রদানের প্রস্তাব করেন। রাজা তখন খাজনা হিসেবে ধানের তুষ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে, জমিদারি এলাকা থেকে সংগৃহীত ধানের তুষ জমিদার বাড়ির পূর্ব পাশে বিশাল ভাণ্ডারে জমা রাখা হতো কোচবিহারের রাজাকে প্রদানের জন্য। এই ঘটনা থেকেই এই জমিদার বাড়ি “তুষভাণ্ডার” নামে পরিচিতি লাভ করে।

জমিদার বংশ ও শাসনামল

মুরারিদেব ঘোষাল ভট্টাচার্যের পরবর্তী বংশধরগণ এই জমিদারি পরিচালনা করেন। এই বংশের একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ রায় চৌধুরী, যাঁর নামানুসারে কালীগঞ্জ উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। জমিদার গীরিন্দ্র মোহন রায় চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ১৯৩৫ সালে এই জমিদার বংশের শাসনামলের অবসান ঘটে।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ির অধিকাংশ স্থাপনা ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে এখনও কিছু প্রাচীন স্থাপনা, যেমন দুর্গ, মন্দির, দিঘি ইত্যাদি এখনও দেখা যায়, যা অতীতের ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। এই ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণ ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ি যাওয়ার উপায়

যারা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী, তাদের জন্য তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ি একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। এখানে পরিদর্শন করে আপনি অতীতের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারবেন। ঢাকা থেকে লালমনিরহাট যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি সুবিধাজনক বিকল্প রয়েছে। আপনি ট্রেন অথবা বাসে করে লালমনিরহাট যেতে পারেন।

ট্রেনে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট

ঢাকা থেকে লালমনিরহাট ট্রেনে যাওয়ার জন্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুটি প্রধান ট্রেন পাওয়া যায়। লালমনি এক্সপ্রেস প্রতিদিন রাত ৯:৪৫ মিনিটে (শুক্রবার ব্যতীত) এবং বুড়িমারী এক্সপ্রেস প্রতিদিন সকাল ৮:৩০ মিনিটে (মঙ্গলবার ব্যতীত) ছেড়ে যায়। ট্রেনের টিকিটের দাম আসনভেদে ৬৩৫ টাকা থেকে ২১৮০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আগে থেকে টিকিট কেটে রাখলে আপনার পছন্দের আসন নিশ্চিত করতে পারবেন।

বাসে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট

ঢাকা থেকে লালমনিরহাট বাসে যাওয়ার জন্য গাবতলী এবং কল্যাণপুর বাস টার্মিনাল থেকে হানিফ এবং শাহ আলী পরিবহনের সহ বিভিন্ন বাস সার্ভিস পাওয়া যায়। এই বাসগুলি নিয়মিতভাবে লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বাসের টিকিটের দাম এবং সময়সূচী পরিবহন কোম্পানির উপর নির্ভর করে। যাত্রা শুরুর আগে সময়সূচী এবং ভাড়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া উচিত।

কোথায় থাকবেন

কালীগঞ্জে রাত্রিযাপনের জন্য সাধারণ মানের কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। তবে, আরও বেশি বিকল্প এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য আপনি লালমনিরহাট শহরে থাকতে পারেন। লালমনিরহাটে বিভিন্ন মানের হোটেল পাওয়া যায়, যার মধ্যে খান হোটেল, হোটেল সীমান্ত আবাসিক, হোটেল অতিথি, হোটেল অবসর, হোটেল মাসুদ এবং উত্তরা হোটেল উল্লেখযোগ্য। আপনার বাজেট এবং পছন্দ অনুযায়ী এই হোটেলগুলো থেকে আপনার জন্যে উপযুক্ত হোটেল নির্বাচন করতে পারেন। আগে থেকে বুকিং করে রাখলে আপনার পছন্দের রুম পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

খাওয়া-দাওয়া

লালমনিরহাটে খাওয়ার জন্য বেশ কিছু ভালো জায়গা আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এবং খাবারের দোকান পাওয়া যায়, যেখানে বাংলা, ভারতীয়, চাইনিজ সহ বিভিন্ন রকম খাবার পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য রেস্টুরেন্টের মধ্যে আছে প্যারাডাইস, সীমান্ত ক্যান্টিন, পলাশী, পালকি, নিউ শান্তি এবং মুক্তিযোদ্ধা হোটেল। স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে চাইলে “গরুর কষা মাংস ভুনা”, “মোরগ পোলাও”, “বিরিয়ানি” ইত্যাদি চেষ্টা করতে পারেন। এছাড়া, ফাস্টফুড প্রেমীদের জন্য বিভিন্ন ফাস্টফুড শপ ও ক্যাফে রয়েছে। খাবারের মান এবং দাম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হতে পারে, তাই স্থানীয়দের সাথে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া ভালো কোথায় ভালো এবং সুলভ খাবার পাওয়া যায়।

তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ি শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, এটি একটি কাহিনী, একটি ঐতিহ্য, যা আমাদের অতীতের সাথে যুক্ত করে রাখে। এই ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

Leave a Comment
Share