সাতক্ষীরা

তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদ

সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে অবস্থিত তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ (Tentulia Jame Masjid), যা খান বাহাদুর সালামতুল্লাহ মসজিদ এবং তেতুলিয়া শাহী মসজিদ নামেও পরিচিত, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য। মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত এই মসজিদটি শুধু একটি উপাসনালয় নয়, বরং এটি তৎকালীন জমিদার পরিবারের আভিজাত্য এবং শিল্পকলার প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রতীক।

তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদটি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে তেঁতুলিয়া গ্রামে অবস্থিত। এটি স্থানীয়ভাবে ‘মিয়ার মসজিদ’ বা ‘তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করে।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্মাণকাল

খান বাহাদুর মৌলভী কাজী সালামাতুল্লাহ খান ছিলেন তেঁতুলিয়ার জমিদার এবং কাজী পরিবারের বংশধর। তিনি ১৮৫৮-৫৯ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি “সালাম মঞ্জিল” নামে একটি জমিদার প্রাসাদও তৈরি করেছিলেন। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা খান বাহাদুর সালামাতুল্লাহ খান তাঁর পিতা মৌলভী কাজী সানা’আতুল্লাহ’র কাছ থেকে ক্ষমতা লাভ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ কাজী আমানাতুল্লাহ ছিলেন কাজী-আল-কুজত (প্রধান বিচারক)। খান বাহাদুর সালামাতুল্লাহ খানের উত্তারাধিকার ছিলেন তাঁর পুত্র মৌলভী কাজী হামিদুল্লাহ খান, এবং তাঁর পুত্র ছিলেন মৌলভী কাজী মুহাম্মদ মিন্নাতুল্লাহ খান। মিন্নাতুল্লাহ খান ছিলেন তেতুলিয়ার কাজী পরিবারের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।

তেঁতুলিয়া শাহী জামে মসজিদ এর স্থাপত্যশৈলী

ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন অনুসরণ করে নির্মিত। এর নির্মাণশৈলী টিপু সুলতানের বংশধরদের তৈরি বিভিন্ন স্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

  • মসজিদে ৭টি দরজা রয়েছে, যেগুলোর উচ্চতা ৯ ফুট এবং প্রস্থ ৪ ফুট। দরজাগুলোর উপরে বিভিন্ন রঙের কাঁচের ঘুলঘুলি রয়েছে।
  • মসজিদের অভ্যন্তরে ১০ বর্গফুট বিশিষ্ট ১২টি পিলার রয়েছে, যেগুলোর উপর ছাদ নির্মিত।
  • মসজিদটি চুনসুরকি ও চিটাগুড়ের গাঁথুনিতে তৈরি। এতে ১৫ ফুট উঁচু ৬টি বড় গম্বুজ এবং ৮ ফুট উঁচু ১৪টি মিনার রয়েছে। এছাড়াও, ২৫ ফুট উঁচু ৪টি মিনার চার কোণে অবস্থিত।
  • কমপ্লেক্সের পাশে ঝুলন্ত ছাদযুক্ত একটি লম্বা বারান্দা রয়েছে, যা দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বারান্দাটি পূর্বে জমিদারদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হত। আগে বারান্দার কোণে পালকি রাখার স্থান ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই ধরনের স্তম্ভবিশিষ্ট স্থাপনা খুব কমই দেখা যেত। স্তম্ভগুলো ছাদকে ধরে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা প্রায় ১০.৫ ফুট।
  • ১৯৮২ সালে সালাম মঞ্জিলের প্রবেশদ্বার “সিংহ দরজা” ধ্বংস হয়ে যায়। পূর্বে এই তোরণ দিয়ে প্রবেশের সময় সবুজ প্রকৃতির সমারোহ দেখা যেত। বর্তমানে এটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে, যদিও সালাম মঞ্জিলের অন্যান্য অংশ এখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত।
  • মসজিদের ভিতরে একসাথে ৩২৫ জন এবং বাইরের চত্বরে ১৭৫ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

মসজিদের পাশে একটি গভীর পুকুর রয়েছে, যা তলদেশ থেকে সিঁড়ি দিয়ে মসজিদ চত্বরের সাথে যুক্ত। ধারণা করা হয়, আগ্রার তাজমহলের নির্মাণশৈলীকে অনুসরণ করে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছে।

ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা হয়ে তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ যাওয়ার উপায়

রাজধানী ঢাকা থেকে সাতক্ষীরাগামী বিভিন্ন এসি/নন-এসি বাস সার্ভিস যেমন এসপি গোল্ডেন লাইন, একে ট্রাভেলস, গ্রীণলাইন, মামুন এন্টারপ্রাইজ, ঈগল, সোহাগ পরিবহন, সৌদিয়া, সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস এবং শ্যামলী পরিবহন গাবতলী, নবীনগর, শ্যামলী, কল্যাণপুর ও সাভার থেকে ছেড়ে যায়। পদ্মা সেতু হয়ে এসব বাসে সাতক্ষীরা পৌঁছাতে জনপ্রতি টিকেট মূল্য ৬৫০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে তেঁতুলিয়া জামে মসজিদের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে বাস, রিকশা অথবা ভ্যানের মতো স্থানীয় পরিবহণে তালা-পাইকগাছা সড়ক ধরে সহজেই তেঁতুলিয়া শাহী মসজিদে পৌঁছানো যায়।

তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ শুধু একটি মসজিদ নয়, এটি বাংলাদেশের স্থাপত্যকলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এর নির্মাণশৈলী, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং জমিদার পরিবারের স্মৃতিচিহ্ন এটিকে বিশেষ করে তুলেছে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Masjidsatkhira