কুষ্টিয়া

টেগর লজ

কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান টেগর লজ (Tagore Lodge), যা কুষ্টিয়া সদরের মিলপাড়া এলাকার মোহিনী মিল ও বড় বাজারের পাশে কবি আজিজুর রহমান সড়কে অবস্থিত। এই স্থানটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এবং সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। এখানে বসেই কবিগুরু অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন, যা পরবর্তীকালে “ক্ষণিকা” এবং “কথা ও কাহিনী” গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

টেগর লজের প্রতিষ্ঠা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবসায়িক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি এবং তার দুই ভাগ্নে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহায়তায় শিলাইদহে টেগর এন্ড কোম্পানি নামে একটি যৌথ মূলধনী ব্যবসা শুরু করেন। ভুষিমাল এবং পাটের ব্যবসার সুবিধার্থে সে বছরই কোম্পানিটি শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত হয়।

কবির ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়, যা বর্তমানে টেগর লজ নামে পরিচিত। তবে শিলাইদহের কুঠিবাড়ির মতো টেগর লজের পরিচিতি ততটা বিস্তৃত নয়। তবুও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও চ্যালেঞ্জ

ভুষিমালের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে আখমাড়াইয়ের কল এবং পাটের গাঁট তৈরির কল স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে স্বদেশি আন্দোলনের চেতনা থেকে টেগর লজকে কেন্দ্র করে একটি বড় তাঁতশালাও স্থাপন করেন। ব্যবসার প্রথম দিকে সফলতা এলেও পরে টেগর এন্ড কোম্পানি লোকসানের সম্মুখীন হয়।

কবিকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহায্য করেন তার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ। তবুও ব্যবসায়িক ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে খুলনার ফুলতলার উদ্যমী যুবক যজ্ঞেশ্বরকে ব্যবসার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যজ্ঞেশ্বরের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি কোনোমতে টিকে থাকলেও, এক সময় কবি নামমাত্র মূল্যে যজ্ঞেশ্বরের কাছে কোম্পানির সব যন্ত্রপাতি ও মালামাল বিক্রি করেন।

স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য

টেগর লজ নয় কাঠা জমির উপর নির্মিত। বাড়িটির প্রবেশ পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। বাড়িটির নিচতলায় একটি বড় হলঘর এবং দোতলায় তিনটি ঘর রয়েছে। একটি ঘরে কবিগুরুর রচিত গ্রন্থমালা এবং আঁকা ১২টি চিত্রের অনুকৃতি প্রদর্শিত হয়।

দোতলায় উঠার জন্য পশ্চিম পাশের একটি প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি রয়েছে, যা বাড়িটির স্থাপত্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।

টেগর লজের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে টেগর লজ একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে টিকে রয়েছে। যদিও শিলাইদহ কুঠিবাড়ির মতো এটির পরিচিতি তুলনামূলক কম, তবে এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। স্থানীয় ও পর্যটকদের কাছে এটি কুষ্টিয়ার ইতিহাসের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

কিভাবে যাবেন টেগর লজ

বাসে

ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় যেতে বাস সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে নিউ এসবি সুপার ডিলাক্স, শ্যামলী, বা হানিফ পরিবহনের বাসে করে কুষ্টিয়া আসতে পারেন। বাসের নন-এসি ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১০০০-১২০০ টাকা। কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছে রিকশা বা অটোরিকশায় চেপে টেগর লজ যাওয়া যাবে।

ট্রেনে

ট্রেনে কুষ্টিয়া যেতে সুন্দরবন এক্সপ্রেস, মধুমতি এক্সপ্রেস, এবং বেনাপোল এক্সপ্রেস ব্যবহৃত হয়।

  • সুন্দরবন এক্সপ্রেস: সকাল ৮:১৫-এ কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাড়ে।
  • মধুমতি এক্সপ্রেস: বিকাল ৩:০০-এ ছাড়ে।
  • বেনাপোল এক্সপ্রেস: রাত ১১:৪৫-এ ছাড়ে।

ট্রেনের টিকিটের মূল্য আসনভেদে ৪১০ থেকে ৯৪৩ টাকার মধ্যে। কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে নেমে শহরে পৌঁছে রিকশা বা সিএনজি নিয়ে টেগর লজ যেতে পারবেন।

কুষ্টিয়ায় কোথায় থাকবেন

কুষ্টিয়া শহরে থাকা-খাওয়ার জন্য মধ্যম মানের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে।

  • মধ্যম মানের হোটেল: হোটেল আজমীরি, প্রীতম হোটেল, এবং জুবলি হোটেল।
  • উচ্চ মানের হোটেল: হোটেল রিভার ভিউ, হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনাল, এবং হোটেল লিবার্টি।

কোথায় খাবেন

কুষ্টিয়া শহরে খাওয়া-দাওয়ার জন্য ভালো মানের রেস্টুরেন্টের অভাব নেই।

  • হোটেল শফি (কোর্ট স্টেশন এলাকায়): স্থানীয় খাবারের জন্য বিখ্যাত।
  • জাহাঙ্গীর হোটেল, শিল্পী হোটেল, এবং খাওয়া-দাওয়া হোটেল: সুস্বাদু খাবারের জন্য জনপ্রিয়।
  • কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা এবং কুলফি মালাই অবশ্যই খেয়ে দেখবেন।

টেগর লজ শুধু একটি ভবন নয়, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিশীলতা, ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং স্বদেশি আন্দোলনের প্রেরণার একটি প্রতীক। কুষ্টিয়ার এই ঐতিহাসিক স্থানটি আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। তাই এটি সংরক্ষণ ও পরিচিতি বাড়ানোর জন্য আরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ kushtiarabindranathtagore