চাঁদপুর জেলার পশ্চিম পাশে পদ্মা, মেঘনা, এবং ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত মোলহেড (Molehead), যা ত্রিনদীর মোহনা (Rallying Point Of Three Rivers) নামেও পরিচিত। এটি শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কেন্দ্র নয়, বরং রহস্যময় কাহিনী ও বিপদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবেও পরিচিত। এখানে নদীর বিশাল স্রোত এবং ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিপাক দেখার জন্য প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমায়।
“মোলহেড” শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ “Molehead” থেকে, যার অর্থ হলো বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের অভিঘাত থেকে ভূমিকে রক্ষা করার জন্য তৈরি পাথর বা কংক্রিটের শক্ত প্রাচীর। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুর শহরকে পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার প্রবল স্রোত এবং ঘূর্ণির প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য বোল্ডার দ্বারা এই বাঁধ নির্মাণ করে। এর ফলেই তৈরি হয় ত্রিকোণাকৃতির মোলহেড, যা আজ চাঁদপুরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক।
ত্রিনদীর মোহনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু লোককাহিনী। জনশ্রুতি অনুসারে, বহু বছর আগে এক দরিদ্র ছেলে এখানে অভিশাপ দিয়েছিল, যার ফলে রাতারাতি এই স্থানটি নদীর অতলে হারিয়ে যায়। আরেকটি কাহিনীতে শোনা যায়, ডুবে যাওয়া একটি লঞ্চে ডুবুরিরা এক ছেলেকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছিল। যদিও এসব গল্পের কোনো প্রমাণ নেই, তবে স্থানটির বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য এসব গল্পের সত্যতার ইঙ্গিত দেয়।
সরকারিভাবে চাঁদপুরের এই নৌপথকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বর্ষাকালে ঘূর্ণিপাকের আশেপাশে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে খুঁটি পুঁতে সতর্কতা দেওয়া হয়। তবুও, প্রতিদিন পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলার, লঞ্চ, এবং কার্গো জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়।
ত্রিনদীর মোহনা চাঁদপুরের অন্যতম প্রধান পর্যটন স্পট। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য মোলহেডে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসে। তবে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে নৌপথের বিপদের কথা মাথায় রেখে এখানে ট্যুর গাইড, উদ্ধার টিম এবং সচেতনতামূলক নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।
চাঁদপুরের মোলহেড ভ্রমণ করতে ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহন মাধ্যম ব্যবহার করা যায়। নিচে রুট, পরিবহন পদ্ধতি এবং খরচসহ বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো।
ঢাকা থেকে চাঁদপুর সড়কপথে যাত্রা সহজ ও তুলনামূলক দ্রুত। গাবতলী, সায়েদাবাদ কিংবা যাত্রাবাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি চাঁদপুরগামী বাস পাওয়া যায়। বাসের ধরন অনুযায়ী ভাড়া নন-এসি বাসে ২০০-৩০০ টাকা এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে পড়ে। যানজট এড়িয়ে চলার জন্য ভোরবেলা রওনা দিলে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে চাঁদপুর পৌঁছানো যায়। বাস থেকে নামার পর স্থানীয় রিকশা বা সিএনজিতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ত্রিনদীর মোহনায় পৌঁছানো সম্ভব। সড়কপথের আরেকটি সুবিধা হলো যাত্রাপথে বিভিন্ন মনোরম স্থানের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। তবে যানজট থাকলে যাত্রার সময় দীর্ঘ হতে পারে, যা ভ্রমণকে কিছুটা ক্লান্তিকর করতে পারে।
নৌপথে চাঁদপুর যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ আকর্ষণ। ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রতিদিন চাঁদপুরগামী লঞ্চ ছাড়ে, যা ভ্রমণকে করে তোলে আরামদায়ক এবং আনন্দদায়ক। ডেকের ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা এবং কেবিন ভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। লঞ্চে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে চাঁদপুর পৌঁছানো যায়। যাত্রাপথে নদীর তীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং নৌকাগুলোর চলাচল পর্যবেক্ষণ ভ্রমণকে মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা করে তোলে। বিশেষত বর্ষার মৌসুমে নদীর সৌন্দর্য আরও বেশি মুগ্ধকর হয়ে ওঠে। তবে নৌপথ নির্ভর করে সময়সূচির ওপর, তাই যাত্রার আগে লঞ্চের নির্ধারিত সময় জেনে নেওয়া ভালো। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ভিড় বেশি থাকায় সময়মতো লঞ্চে উঠার প্রস্তুতি রাখা উচিত।
মাধ্যম | সময় (ঘণ্টা) | ভাড়া (টাকা) | সুবিধা | অসুবিধা |
---|---|---|---|---|
বাস | ৩-৪ | ২০০-৫০০ | সহজলভ্য এবং দ্রুত | যানজট নির্ভর |
লঞ্চ | ৩-৪ | ১৫০-১০০০ | আরামদায়ক, নদীর সৌন্দর্য উপভোগ | সময়সূচি নির্ভর এবং ধীরগতি |
চাঁদপুর শহরে থাকার জন্য মোটামুটি মানের কিছু হোটেল রয়েছে। ভাই ভাই আবাসিক হোটেল, তালতলা বাসস্টেশন হোটেল সকিনা, নতুনবাজার। ভাড়া: হোটেলভেদে ৪০০-৬০০ টাকা
চাঁদপুর শহরে গেলে অবশ্যই বড় স্টেশন সংলগ্ন হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। তিন-চারজন বা এরচেয়ে বড় গ্রুপ হলে রেলস্টেশনের পাশের ইলিশের বাজার থেকে আস্ত ইলিশ মাছ কিনে হোটেল থেকে রান্না করিয়ে নিতে পারেন। এতে খরচ কম পড়বে এবং খেয়েও মজা পাবেন। কালিবাড়ি মোড়ে ওয়ান মিনিট দোকানের আইসক্রিম বেশ বিখ্যাত। দাম ৪০ টাকা।
আপনার পরবর্তী ভ্রমণ পরিকল্পনায় মোলহেডকে যোগ করুন এবং প্রকৃতির এক অনন্য সৌন্দর্যের সাক্ষী হোন।
Leave a Comment