রংপুর শহরের বুকে এক টুকরো সবুজের সমারোহ, যেখানে প্রকৃতির নীরবতা আর আধুনিক বিনোদনের ছোঁয়া মিলেমিশে একাকার – সেটাই চিকলির বিল। স্থানীয়দের কাছে এটি শুধু একটি বিল নয়, বরং এক প্রাণবন্ত বিনোদন কেন্দ্র। কয়েক বছরের মধ্যেই এই বিল এবং এর সংলগ্ন বিনোদন পার্কটি রংপুরবাসীর মন জয় করে নিয়েছে।
হনুমানতলা এলাকায় অবস্থিত এই চিকলির বিলটি প্রায় শতবর্ষের পুরোনো। শীতকালে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চিকলি বিলের চারপাশ। পাখির ঝাঁক যেন এক ভিন্ন জগৎ তৈরি করে, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। একসময় এই চিকলির বিলটি সি প্লেনের ল্যান্ডিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখে এর চারপাশে একটি আধুনিক বিনোদন পার্ক গড়ে তুলেছে। বিলের পাড়ে মনোরম পরিবেশে বসে সময় কাটানোর জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে বসার স্থান, যা এই অঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়।
এখানে শিশুদের বিনোদনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে মিনি রেলগাড়ি, চরকি এবং অন্যান্য রাইড। বিলে ঘোরার জন্য প্যাডেলবোটের ব্যবস্থা রয়েছে, যা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে বনভোজন এবং আনন্দ-উল্লাস করতে আসে। চিকলি বিল এখন রংপুরবাসীর কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
বর্তমানে চিকলির বিল দুটি অংশে বিভক্ত। বিলের দক্ষিণ দিকে গড়ে উঠেছে “চিকলি ওয়াটার পার্ক”, যেখানে প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা। এখানে বিভিন্ন ওয়াটার রাইড রয়েছে যা দর্শনার্থীদের আনন্দ দেয়। অন্যদিকে, বিলের উত্তর পাশের নাম “চিকলি ওয়াটার গার্ডেন”, যার প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা।
বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত চিকলি বিনোদন পার্কের পাশে একটি রিসোর্টও রয়েছে। এখানে আলাদা আলাদা সিটিং এরিয়ার ৫টি রেস্টুরেন্ট আছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্বাদ নেওয়া যায়। এছাড়াও, এখানে জেট স্কি এবং অন্যান্য ওয়াটার রাইড, কৃত্রিম জলপ্রপাত, টয় ট্রেন ও বিশাল চরকি সহ বিভিন্ন রাইড রয়েছে।
চিকলির বিশাল চরকিতে চড়ে পুরো রংপুর শহরের পাখির চোখে দৃশ্য দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেলে এই বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার অনুভূতি অসাধারণ।
চিকলি ওয়াটার পার্কের প্রধান আকর্ষণ হলো কৃত্রিম ঝর্না। রাতের বেলায় এই ঝর্ণা দেখতে আরও বেশি সুন্দর লাগে। বিভিন্ন রঙের আলো এটিকে এক ভিন্ন রূপ দেয়, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলে। পার্কের ভেতরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট খাল রয়েছে, যেখানে রঙিন মাছ খেলা করে। দর্শনার্থীরা চাইলে স্পিডবোটে চড়ে বিলটি ঘুরে আসতে পারেন। এছাড়া, বিভিন্ন স্থানে চেয়ার এবং বেঞ্চের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেখানে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়।
ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবহন হলো গ্রীন লাইন এবং টি আর ট্রাভেলস। এছাড়া এ রুটে আগমনী পরিবহন, এস আর, শ্যামলী, হানিফ, কেয়া ইত্যাদি পরিবহনের সাধারণ বাস চলাচল করে। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ছাড়ে এসব বাস।
রংপুর পৌঁছে চিকলির বিল পৌছার পথ মূলত দুটি – একটি সাগরপাড়ার দিয়ে আরেকটি শহরের পুলিশ লাইনের সামন দিয়ে হনুমানতলা বাজার পার হয়ে একটু সামনেই হাতের বামেই বিলে প্রবেশের পথ। চিকলির বিল যাওয়ার কথা বললে সহজেই রিকশা কিংবা অটো পেয়ে যাবেন। সেখানে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের জায়গা থাকায় প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও সহজেই ঘুরে আসতে পারেন বিখ্যাত চিকলির বিল থেকে।
চিকলি বিল শুধু একটি বিনোদন কেন্দ্র নয়, এটি রংপুরের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ। এই বিলকে কেন্দ্র করে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রংপুরবাসীর একটাই আশা, চিকলি বিল তার আপন মহিমায় আবারও জেগে উঠবে এবং পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে।
Leave a Comment